১২:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আসন্ন বাজেটে নিত‍্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ

আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে চাল, ডাল, আটা, চিনি, ডিম, মুরগি ও মাছের মতো অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে পোল্ট্রি, গবাদিপশু ও মাছের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড় দেওয়া হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে সরকারের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া মূল্য কমিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

এ কারণে বাজেট প্রণয়নে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। দুই বছর পর আবারও অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। অন্যদিকে এসব পণ্যের দেশীয় উৎপাদনেও বীজ, সার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।

এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে বেশ কয়েক বছর ধরেই অত্যাবশ্যকীয় ১৭ ভোগ্যপণ্য, যেমনÑ চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি ও সকল প্রকার ফল ইত্যাদির সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর দুই শতাংশ হারে কর্তনের বিধান বাতিল করার প্রস্তাব করে আসছে।

এটা করা হলে বাজেট ঘোষণার পরও নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করে এফবিসিসিআই। দেশের বিদ্যমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে খাদ্য, কৃষি সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সারের ওপর কর না বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবার বাজেট সামনে রেখে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না করা হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি বাতিল করা হতে পারে কিংবা এটি দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হতে পারে
শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের কারণে বিশ্বজুড়েই অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজার। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বেশিরভাগ ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
এতে করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। আয়ের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যপণ্য কিনতে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ- বাজেটে খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে কী পদক্ষেপ থাকছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।

এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা বেশ কঠিন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। তিনি বলেন, খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ধান, চাল, পেঁয়াজ, মাছ, পোল্ট্রি ও গবাদিপশু উৎপাদন ও লালন-পালনে সরকারের ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষকের স্বার্থে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা, খোলা বাজারে চাল, আটা (ওএমএস) বিক্রি কার্যক্রম জোরদার এবং টিসিবির উপকারভোগী বাড়ানোর মতো কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে প্রস্তাবিত বাজেটে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায়ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ থাকছে।

একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে। বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্যের আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখা এবং অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানিতে প্রযোজ্য শুল্ক-করভার স্থিতাবস্থায় রাখার প্রস্তাব করা হবে।

দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য প্রস্তুতিতে হোয়েট গ্লুটেন ব্যবহৃত হয়। প্রাণীজ শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং ভোক্তাদের স্বল্পমূল্যে আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উক্ত পণ্যের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে আরও কমানো হতে পারে। গো-খাদ্য উৎপাদনে আখ ও চিটাগুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গো-খাদ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে আরও কমিয়ে আনার ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
এতে পোল্ট্রি খাতের মুরগি ও গবাদিপশু পালন উৎপাদন বাড়বে। এ ছাড়া মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে এসব খাতের খাদ্যসামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে বিগত সময়ে প্রদত্ত শূন্য শুল্কহার এবং অন্যান্য হারে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং খাদ্যশস্যের সরবরাহের ওপর কর কমানো উচিত। সিপিডি উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এ ধরনের কর হ্রাসের পক্ষে অনেক আগে থেকেই কথা বলে আসছে। এর ফলে নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি ফিরে আসবে। এ ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে করহার কমানোর জন্য অনুরোধ করছি। এ উদ্যোগ খাদ্য মূল্যস্ফীতি রোধে সহায়ক হবে।

কর ও ভ্যাট আদায়ে যেসব পরিবর্তন আসছে ॥ আসন্ন বাজেটে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশেষ কিছু জায়গায় কর ও ভ্যাটে ছাড় থাকলেও এবার রাজস্ব আদায়ের আওতা আরও বাড়ানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি আগামী অর্থবছরে ফের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসতে পারে। এই সুযোগ দেওয়া হতে পারে এক বছরের জন্য। দুই বছর আগে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমন সাড়া না পাওয়ায় পরে এ সুযোগ বাতিল করা হয়। এর পরের বছর দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ এই সুযোগ নেয়নি। এক বছর বিরতির পর আগামী অর্থবছরে আবারও ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না ॥ আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। তবে করদাতার হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে আয়কর আইনে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে এনবিআর।
এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যক্তি ও কোম্পানিÑ দুই শ্রেণির করদাতাই কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। এনবিআর মনে করে, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়লে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী আয়করের আওতার বাইরে চলে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে মানুষের আয়ও বেড়েছে। তাই সীমা বাড়ানোকে যৌক্তিক মনে করে না সংস্থাটি। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে।

২০২০-২১ সালে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়। বর্তমানে নারী করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা চার লাখ টাকা।

এ ছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়াতে মোবাইল ফোন কলের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হবে। বর্তমানে গ্রাহকরা ১০০ টাকা দিয়ে মোবাইল রিচার্জ করলে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ কেটে নেওয়ার পর ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। আবারও সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হলে গ্রাহকরা ১০০ টাকার মধ্যে ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার কথা বলতে পারবেন।

করপোরেট করহার ॥ শর্তসাপেক্ষে করপোরেট করহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। উৎপাদনশীল খাতে তালিকাভুক্ত নয় এমন শিল্পে কর সাড়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা করা হতে পারে। তবে অন্য সব খাতে কর অপরিবর্তিত থাকবে।

এ ছাড়া কৃষি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিত্তবানদের ওপর বাড়তি কর আরোপের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। ১৬ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিপর্যায়ের করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি হ্রাস এবং শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ থেকে মূলধনী আয়ের ওপর কর ছাড় প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে পরে এটি সংশোধন করে চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে সৌম্যর সরকারের মধ্যে

বিজ্ঞাপনের নামে ৬ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে অনলাইন টিভির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

আসন্ন বাজেটে নিত‍্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ

আপডেট টাইম : ০৫:৪৪:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ জুন ২০২৪

আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে চাল, ডাল, আটা, চিনি, ডিম, মুরগি ও মাছের মতো অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে পোল্ট্রি, গবাদিপশু ও মাছের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড় দেওয়া হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে সরকারের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া মূল্য কমিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

এ কারণে বাজেট প্রণয়নে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। দুই বছর পর আবারও অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। অন্যদিকে এসব পণ্যের দেশীয় উৎপাদনেও বীজ, সার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।

এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে বেশ কয়েক বছর ধরেই অত্যাবশ্যকীয় ১৭ ভোগ্যপণ্য, যেমনÑ চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি ও সকল প্রকার ফল ইত্যাদির সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর দুই শতাংশ হারে কর্তনের বিধান বাতিল করার প্রস্তাব করে আসছে।

এটা করা হলে বাজেট ঘোষণার পরও নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করে এফবিসিসিআই। দেশের বিদ্যমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে খাদ্য, কৃষি সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সারের ওপর কর না বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবার বাজেট সামনে রেখে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না করা হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি বাতিল করা হতে পারে কিংবা এটি দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হতে পারে
শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের কারণে বিশ্বজুড়েই অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজার। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বেশিরভাগ ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
এতে করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। আয়ের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যপণ্য কিনতে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ- বাজেটে খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে কী পদক্ষেপ থাকছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।

এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা বেশ কঠিন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। তিনি বলেন, খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ধান, চাল, পেঁয়াজ, মাছ, পোল্ট্রি ও গবাদিপশু উৎপাদন ও লালন-পালনে সরকারের ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষকের স্বার্থে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা, খোলা বাজারে চাল, আটা (ওএমএস) বিক্রি কার্যক্রম জোরদার এবং টিসিবির উপকারভোগী বাড়ানোর মতো কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে প্রস্তাবিত বাজেটে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায়ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ থাকছে।

একই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে। বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্যের আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখা এবং অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানিতে প্রযোজ্য শুল্ক-করভার স্থিতাবস্থায় রাখার প্রস্তাব করা হবে।

দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য প্রস্তুতিতে হোয়েট গ্লুটেন ব্যবহৃত হয়। প্রাণীজ শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং ভোক্তাদের স্বল্পমূল্যে আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উক্ত পণ্যের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে আরও কমানো হতে পারে। গো-খাদ্য উৎপাদনে আখ ও চিটাগুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গো-খাদ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে আরও কমিয়ে আনার ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
এতে পোল্ট্রি খাতের মুরগি ও গবাদিপশু পালন উৎপাদন বাড়বে। এ ছাড়া মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে এসব খাতের খাদ্যসামগ্রী ও নানাবিধ উপকরণ আমদানিতে বিগত সময়ে প্রদত্ত শূন্য শুল্কহার এবং অন্যান্য হারে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য এবং খাদ্যশস্যের সরবরাহের ওপর কর কমানো উচিত। সিপিডি উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এ ধরনের কর হ্রাসের পক্ষে অনেক আগে থেকেই কথা বলে আসছে। এর ফলে নিত্যপণ্যের দামে স্বস্তি ফিরে আসবে। এ ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে করহার কমানোর জন্য অনুরোধ করছি। এ উদ্যোগ খাদ্য মূল্যস্ফীতি রোধে সহায়ক হবে।

কর ও ভ্যাট আদায়ে যেসব পরিবর্তন আসছে ॥ আসন্ন বাজেটে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশেষ কিছু জায়গায় কর ও ভ্যাটে ছাড় থাকলেও এবার রাজস্ব আদায়ের আওতা আরও বাড়ানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি আগামী অর্থবছরে ফের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসতে পারে। এই সুযোগ দেওয়া হতে পারে এক বছরের জন্য। দুই বছর আগে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমন সাড়া না পাওয়ায় পরে এ সুযোগ বাতিল করা হয়। এর পরের বছর দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ এই সুযোগ নেয়নি। এক বছর বিরতির পর আগামী অর্থবছরে আবারও ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না ॥ আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। তবে করদাতার হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে আয়কর আইনে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে এনবিআর।
এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যক্তি ও কোম্পানিÑ দুই শ্রেণির করদাতাই কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। এনবিআর মনে করে, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়লে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী আয়করের আওতার বাইরে চলে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে মানুষের আয়ও বেড়েছে। তাই সীমা বাড়ানোকে যৌক্তিক মনে করে না সংস্থাটি। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে।

২০২০-২১ সালে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়। বর্তমানে নারী করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা চার লাখ টাকা।

এ ছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়াতে মোবাইল ফোন কলের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হবে। বর্তমানে গ্রাহকরা ১০০ টাকা দিয়ে মোবাইল রিচার্জ করলে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ কেটে নেওয়ার পর ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। আবারও সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হলে গ্রাহকরা ১০০ টাকার মধ্যে ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার কথা বলতে পারবেন।

করপোরেট করহার ॥ শর্তসাপেক্ষে করপোরেট করহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। উৎপাদনশীল খাতে তালিকাভুক্ত নয় এমন শিল্পে কর সাড়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা করা হতে পারে। তবে অন্য সব খাতে কর অপরিবর্তিত থাকবে।

এ ছাড়া কৃষি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিত্তবানদের ওপর বাড়তি কর আরোপের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। ১৬ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিপর্যায়ের করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি হ্রাস এবং শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ থেকে মূলধনী আয়ের ওপর কর ছাড় প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে পরে এটি সংশোধন করে চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।